জসিম উদ্দিন, নুরুল আফসার ও জহির উদ্দিন। এরা তিন বন্ধু। এরা নিজেদের পাকস্থলী ভাড়া দেয়। পাকস্থলীতে মাদক ঢুকিয়ে নিয়ে যায় নির্দিষ্ট স্থানে। বিনিময়ে তারা পায় মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবেই পাকস্থলী ভাড়া দিয়ে চলছিল বেশ ভালোই। কিন্তু বিধি বাম। ধরা পড়ে যায় তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে। তাদের এক্স-রে করা হয়। পাকস্থলীতে ইয়াবার আলামত দেখে পুলিশ ও চিকিৎসকরা হতবাক। মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে মাদক ব্যবসায়ীরা চাপের মধ্যে রয়েছে। তবুও থেমে নেই মাদক পাচার। নানা কৌশলে আসছে মাদক। এর মধ্যে পাকস্থলীতে করে মাদক পাচারের ঘটনাটি অভিনব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১০ জুন রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে এই তিন বন্ধুকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরা টেকনাফ থেকে পাকস্থলীতে করে ইয়াবা নিয়ে আসে ঢাকায়। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, তারা ইয়াবা ব্যবসায়ী নয়। বহনকারী। এক চালান ইয়াবা টেকনাফ থেকে ঢাকায় পৌঁছে দিলে গাড়ি খরচ বাদে তারা ১৫ হাজার টাকা করে হাজিরা পায়। এক চালানে একজন সর্বনিম্ন এক হাজার থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার পিস ইয়াবা পেটে করে আনতে পারে। ইয়াবার প্যাকেট পানি দিয়ে গিলতে গেলে অনেক ক্ষেত্রে বমি হয়ে যায়। এ জন্য সাগর কলার মধ্যে প্যাকেট ঢুকিয়ে তা গিলে ফেলে। কক্সবাজারের ডিলার বদিউল আলমের ইয়াবা বহনে কাজ করে তারা। তাদের বাড়ি টেকনাফে। তারা মৃত্যুকে তোয়াক্কা না করেই পাকস্থলীতে করে ইয়াবা পাচার করে দিচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় বহনকারীর মৃত্যু হতে পারে। তাদের মতে, পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন করলে যেকোনো সময় নাড়ি ছিদ্র কিংবা পেঁচিয়ে যেতে পারে। পাকস্থলীতে ইয়াবা প্রবেশ করানোর পর তারা পায়ুপথ দিয়ে বের করে। যদি বের না হয়, তাহলে জরুরি অস্ত্রোপচার করা ছাড়া উপায় থাকবে না। এ ছাড়া বহনকারী যে পলিথিনে ভরে ইয়াবা গিলে ফেলে, সেই পলিথিন যদি পেটের ভেতরে ছিঁড়ে যায়, তাহলে ইয়াবার বিষ শরীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এতে হঠাৎ মৃত্যুও হতে পারে তার। মাদক নির্মূলে চলমান অভিযানের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিত্য নতুন কৌশলে পাচার হচ্ছে ইয়াবা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে রীতিমতো বোকা বানিয়ে সক্রিয় ইয়াবা কারবারিরা। নারকেলের ভিতর, আমের ভিতর, জুতার ভিতর, মাছের ভিতর, মোবাইলের ভিতর, পায়ুপথে করে ইয়াবা বড়ি পাচার হচ্ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা অভাবী মানুষকে টার্গেট করে একের পর এক ইয়াবার চালান পৌঁছাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মোটা পলিথিনে ৫০টি ইয়াবা ভরে একটি প্যাকেট করা হয়। এরপর ওই প্যাকেট স্কচটেপ দিয়ে মোড়ানো হয়। একেকজন সর্বনিম্ন ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৫০টি প্যাকেট কলার মধ্যে নিয়ে গিলে ফেলে। পায়ুপথ দিয়ে সেগুলো বের না করা পর্যন্ত কোনো খাবার খায় না তারা। টেকনাফ থেকে এভাবে পেটে করে ইয়াবা ঢাকায় এনে পায়ুপথ দিয়ে বের করে পৌঁছে দেয় পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। পাকস্থলীতে ইয়াবা বহনের সময় সম্প্রতি বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং শুল্ক ও গোয়েন্দা সংস্থা। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, কক্সবাজারে অবস্থানরত রেজওয়ান দীর্ঘদিন ধরে উখিয়া থানাধীন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ অন্যান্য ক্যাম্পে অবস্থানরত অসহায় ও দরিদ্র রোহিঙ্গাদের টার্গেট করে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকস্থলীর মাধ্যমে ইয়াবা বহন করতে বাধ্য করে। মামুন শেখ এবং তার সহযোগী রেজোয়ান দীর্ঘদিন ধরে কৌশলে ইয়াবা ব্যবসা করে আসছে। এই চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গত ২৫ মে রাজধানীর আগারগাঁও থেকে নারিকেলের মধ্যে বিশেষ পন্থায় ঢুকানো ৩ হাজার ৯৭৫ পিস ইয়াবাসহ মো. মোশারফ হোসেন (২৪) নামের এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে র্যাব-২ এর একটি দল। র্যাব-২ এর উপঅধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ আলী বলেন, কারও সন্দেহ এড়াতে মোশাররফ নারিকেলের ছোবড়ার একটি অংশ কেটে নারিকেলের পানি ফেলে দিয়ে পলিথিনে ইয়াবা ট্যাবলেট পেঁচিয়ে তার ভিতরে ঢুকিয়েছিল। পরে ওই নারিকেলের কাটা সেই ছোবড়া আঠা (গাম) দিয়ে লাগিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। এর আগে ১৫ মে মোহাম্মদপুরের মুনসুরাবাদ হাউজিং থেকে প্রাইভেটকারের তেলের ট্যাংকিতে রাখা ৬৫ হাজার পিস ইয়াবা বড়িসহ ইকবাল ও গিয়াসউদ্দীনকে র্যাব-২ গ্রেফতার করে। গাড়িটি সিএনজি গ্যাসে চালিত হওয়ায় তেলের ট্যাংকি খুলে বিশেষ পন্থায় ইয়াবার প্যাকেটগুলো ভরে কক্সবাজার থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়িয়ে নির্বিঘ্নে ঢাকায় নিয়ে আসে ইয়াবার কারবারিরা। এর আগে গত ২০১৬ সালের ৩ জুন রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে মোস্তফা কামাল আপন নামের এক যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করে রেলওয়ে পুলিশ আমের মধ্যে লুকানো এক হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। ওই যাত্রী চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে করে ঢাকায় এসেছিল। পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, ইয়াবা যাতে দেশে ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারি রয়েছে। সন্দেহভাজনদের চেকপোস্টে তল্লাশি করা হয়। তবে পাকস্থলীর মধ্যে ইয়াবা বহন করলে তা ধরা একটু কঠিন। এরপরও সন্দেহভাজনদের এক্সরে করা হয়। স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে যারা পাকস্থলীতে ইয়াবা বহন করছে, তাদের সচেতন হতে হবে। ইয়াবা বহন করে যে টাকা তারা পাবে, তার চেয়ে ক্ষতি বেশি— এটা তাদের ভাবা দরকার।
- প্রচ্ছদ
- »
- প্রধান সংবাদ
- »
- ভাড়া হচ্ছে ‘পাকস্থলী’